সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪ , ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

Dainik Provat

চীনে ম্যালেরিয়া কুপোকাত : শিক্ষাটি প্রয়োজন আমাদের ডেঙ্গু নিধনে

মতামত

সুধীর সাহা

প্রকাশিত: ১০:০৩, ২৮ জুলাই ২০২৩

সর্বশেষ

চীনে ম্যালেরিয়া কুপোকাত : শিক্ষাটি প্রয়োজন আমাদের ডেঙ্গু নিধনে

ছবি সংগ্রহ

আমেরিকা-রাশিয়া-চীন, বিশ্ব রাজনীতির ত্রিমুখী স্রোত বইছে আজকের পৃথিবীতে। এই তিন শক্তিধর রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের ওঠা-পড়ার সঙ্গে অনেকের মতো জড়িয়ে আছে ভারত এবং বাংলাদেশের স্বার্থ। কৌশলগত, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক এবং প্রতিরক্ষা সব ক্ষেত্রেই এই পারস্পরিক সম্পর্কের ছায়া পড়ছে। আমেরিকা-রাশিয়া সম্পর্ক এখনো অথৈ জলে। সম্প্রতি জেনেভায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বৈঠকেও সেই বরফ গলার সম্ভাবনা দেখা যায়নি। মস্কো-বেইজিং সম্পর্ক ক্রমেই কাছে ঘেঁষছে এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। এমন বিচিত্র পরিস্থিতির কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে ভারত; আর পাশেই আছে বাংলাদেশ। পশ্চিমের চীনবিরোধী সব পরিকল্পনায় ভারতকে রাখা হচ্ছে। কোয়াড তার একটি বড় উদাহরণ। কিন্তু এরপরও ভারতকে চীনবিরোধী জাহাজে চড়াটা কতটা বাস্তবসম্মত, তা তাদের ভাবতে হচ্ছে। বাংলাদেশের অবস্থা আরো কিছুটা নাজুক বৈকি! চীনকে বাংলাদেশের প্রয়োজন। কতটা প্রয়োজন, তা বোঝা গেল যখন ভারত বাংলাদেশকে আর কোনো টিকা দিতে পারবে না বলে সাফ জানিয়ে দিল এবং বাংলাদেশ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে কোনো টিকা সংগ্রহ করতে পারল না। চীন এগিয়ে এলো এবং বাংলাদেশকে টিকা দিয়ে অনেক বড় উপকার করে বাধিত করল। একদিকে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব এবং অন্যদিকে চীন-রাশিয়া- আসন্ন বিশ্বনীতি যদি এই স্পষ্ট দুভাগে ভাগ হয়ে যায় তখন ভারত এবং বাংলাদেশের মতো দেশগুলো কূটনৈতিক সংকটে পড়বে।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর সেনাবাহিনীর কেমন শক্তি তা যাচাই করতে সমীক্ষা চালায় প্রতিরক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘মিলিটারি ডিরেক্ট’। সম্প্রতি সেই সমীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে ‘আল্টিমেট মিলিটারি স্ট্রেংথ ইনডেক্স’ অর্থাৎ ‘প্রকৃত সামরিক শক্তি সূচক’ নামে। সূচকে ১০০-এর মধ্যে ৮২ পয়েন্ট পেয়ে শীর্ষে আছে চীন। সামরিক খাতে সবচেয়ে বেশি খরচ করেও আমেরিকা ৭৪ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে। রুশ সেনাবাহিনীর শক্তি বিশ্বে তৃতীয়। তাদের পয়েন্ট ৬৯। ৬১ পয়েন্ট পেয়ে তালিকায় চতুর্থ স্থানে আছে ভারত। ৫৮ পয়েন্ট পেয়ে ফ্রান্স ভারতের পরে অবস্থান করছে। ৪৩ পয়েন্ট নিয়ে ব্রিটেন নবম স্থানে।
শতবর্ষ আগে ১৯২১ সালের ১ জুলাই চীনে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম হয়েছিল। সদস্য সংখ্যার হিসাবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, যারা ১৯৪৯ থেকে একচেটিয়া চীনের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তাদের নেতৃত্বেই চীন আজ স্বমহিমায় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এক সমাজতান্ত্রিক ও শক্তিশালী দেশ হিসেবে বিরাজমান। এ সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করা হয় যে, কমিউনিজমকে চীনের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে একাত্ম করা এবং সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদের মেলবন্ধন ঘটানো। বিগত কয়েক দশক ধরে কমিউনিস্ট সরকারের দ্বারা সমাজের সর্বস্তরের অভূতপূর্ব উন্নয়ন এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নতি হলেও সরকারবিরোধী যে কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে। সে কারণে বহির্বিশ্বে চীনের কমিউনিস্ট সরকার অত্যাচারী শাসকের তকমা এখন পর্যন্ত ছাড়তে পারেনি।
এক বাড়িতে একটি বিড়াল ছিল। বিড়ালটি খুব সুন্দর লাফিয়ে লাফিয়ে শিকার করত। সে জন্য বিড়ালকে বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসত। অধিক ভালোবাসায় বিড়ালটি ওই বাড়ির আদুরে পোষ্য হয়ে ওঠে। তাকে আদর করে দুধ, মাছ ইত্যাদি খাওয়ানো শুরু করে পরিবারটি। কিছুদিন পর থেকে বিড়ালটির শিকার করা বন্ধ ও তার কিছুদিন পর থেকে শুধু ঘুম আর আহার, আহার আর ঘুম। পৃথিবীর অনেক ধনী দেশ বিনামূল্যে অনেক কিছু পেয়ে উচ্চাকক্সক্ষা, ঘুম আর আহারে সীমাবদ্ধ হয়ে গেলেও এবং কেউ এ ফলাফলের শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলেও চীন ঠিকই এ শিক্ষা গ্রহণ করেছে যে, বসে থাকা নয়, অলসতা নয়- কাজ আর কাজ সমাজ জীবনের মূল স্রোতধারা হতে হবে। চীন এগিয়েছে এমন করেই।
কোভিড নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব চীনের বিরুদ্ধে যেভাবেই প্রোপাগান্ডা চালাক, চীন শুধু কোভিডকে জয় করেছে তা-ই নয়। বরং সারা বিশ্বের ব্যবসা যখন কোভিডের আঘাতে জর্জরিত, তখন চীন একহাতে সারা বিশ্বে দাপিয়ে ব্যবসা করে গিয়েছে। কোভিড তাই তাদের কাছে অভিশাপের না হয়ে বাণিজ্যে বসতি অনুসর্গ হয়েই ধরা দিয়েছে। এবার চীনের স্বাস্থ্য খাতের দিকে তাকানো যাক। গত জুনের শেষদিকেই জানা গেল যে, সে দেশের মধ্যে গত চার বছরে আর ম্যালেরিয়া রোগী দেখা যাচ্ছে না। ২০২১ সালের মে মাসে সরেজমিন তদন্ত করল ম্যালেরিয়া এলিমিনেশন সার্টিফিকেশন প্যানেল। স্বাধীন এই সংস্থার সুপারিশ মেনে স্বীকৃতির সার্টিফিকেট ইস্যু করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। শাসক দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষের সমারোহে যুক্ত হলো আর একটু নতুন রং। তিন দশকের মধ্যে এই প্রথম পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কোনো দেশকে এমন স্বীকৃতি দেয়া হলো। এর আগে ১৯৮১ সালে অস্ট্রেলিয়া, ১৯৮২ সালে সিঙ্গাপুর এবং ১৯৮৭ সালে ব্রুনাই জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে এই কৃতিত্ব অর্জন করে। সারা বিশ্বের দিকে তাকালে ৪০টি দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে, যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ম্যালেরিয়া মুক্তির স্বীকৃতি বর্ষিত হয়েছে। তবে আয়তনের দিক থেকে চতুর্থ, জনসংখ্যার দিক থেকে প্রথম এবং অতীতে নিষ্ঠুর ইতিহাসের সাক্ষী চীনের এ সাফল্যকে দেখতে হবে ভিন্ন চোখে। ১৯৪০-এর দশকে ৩ কোটি ম্যালেরিয়া রোগী থেকে ৭০ বছরের মধ্যে আজ একটি রোগীও না থাকা নিঃসন্দেহে এক মহাকাব্যিক অর্জন। তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প ছিল ‘৫২৩ প্রজেক্ট’। ১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া এ কর্মসূচিতে ম্যালেরিয়ার নতুন ওষুধ খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে দেশজুড়ে গবেষণা শুরু হয়। ৬০টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় পাঁচশ বিজ্ঞানী যুক্ত হন এ কাজে। ৭০-এর দশকে আবিষ্কৃত হয় কার্যকরী ওষুধ আর্টেমিসিনিন। ১৯৭২ সালে মূলত তু ইউইউর নেতৃত্বে এ আবিষ্কার সম্ভব হয়। ২০১৫ সালে এর জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারও পান তিনি। চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশের অনেক আগেই ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক মাখানো মশারির ব্যবহার শুরু করে দেয়। ১৯৮৮ সাল নাগাদ সে দেশে ২৪ লাখ এমন মশারি বিতরণ হয়েছিল। এর ফলে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ কমে আসে উল্লেখযোগ্যভাবে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে কড়া নিরীক্ষণ ও অ্যানোফিলিস মশা নিয়ন্ত্রণের ফলে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা সেখানে কমে আসে। মৃত্যুর পরিমাণ হ্রাস পায় প্রায় ৯৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের ১-৩-৭ ফর্মুলাও প্রশংসিত হয়েছে। ম্যালেরিয়া রোগের শনাক্তকরণ করতে হবে একদিনের মধ্যে, ৩ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে ম্যালেরিয়া নিশ্চিত করে রিপোর্ট দিতে হবে এবং ৭ দিনের মাথায় আটকে দিতে হবে ছড়িয়ে পড়ার যাবতীয় সম্ভাবনাকে।
বাণিজ্য বাড়লে মেলামেশা বাড়ে, ঘরের মানুষ পরের দেশে যায়। ভিনদেশিদেরও আসতে দিতে হয় চীনের সীমানার মধ্যে। কিন্তু চীন বসে থাকেনি এই সমস্যা সমাধানে। ২০১৬ সালে চীনের মধ্যে মাত্র ৩ জনের ম্যালেরিয়া হলেও আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আমদানি হলো ৩ হাজার ম্যালেরিয়ার ঘটনা। পরের বছর দেশীয় ম্যালেরিয়ার সংখ্যা শূন্য এবং সব ঘটনাই ঘটল বাইরে থেকে আসা। এর ফলে ম্যালেরিয়া পরজীবীর যে প্রজাতি চীনে রোগভোগের জন্য দায়ী ছিল, চীন তাতেও নিয়ে এলো পরিবর্তন। ২০২১ সালে এসে তারা শূন্যের কোটায় নামিয়ে নিল ম্যালেরিয়াকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালে বিশ্বে প্রায় ২৩ কোটি ম্যালেরিয়া রোগী ছিল এবং এর মধ্যে মৃত্যু হয় ৪ লাখ ৯ হাজার রোগীর। সংক্রমণের ৯৪ শতাংশই ঘটেছিল আফ্রিকায়। আফ্রিকায় চীনের বিনিয়োগ ১০ হাজার কোটি ডলারের এবং সেখানে বসবাসকারী চীনাদের সংখ্যা ৩০ লাখ। অন্যদিকে শুধু চীনের গুয়াংদং প্রদেশেই লেখাপড়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে বাস করছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ আফ্রিকাবাসী। মানবসম্পদের এই বিনিময় চীনের বাণিজ্যে সোনা ফলাচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার জন্য ম্যালেরিয়ার ভয়ও আছে তাদের। তারপরও তারাই পারল ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘নো ম্যালেরিয়া’ সনদ লাভ করতে। কীভাবে সম্ভব হলো এমনটা? চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ উদযাপনের প্রাক্কালে নাগরিকদের উদ্দেশে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে শাসক দলের আর্জি ছিল- ‘দলকে মেনে চলুন, ভদ্র আচরণ করুন’। সেই বার্তা নিয়ে ব্যানার আর বিলবোর্ডে সয়লাব হয়েছিল গলি থেকে রাজপথ। ১৯৮৩ সালের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের বিক্ষোভ থেকে শুরু করে সম্প্রতি উহানে করোনার খবর ফাঁসের ঘটনা- বজ্র আঁটুনিতেই রেখেছে শাসকগোষ্ঠী পুরো চীনকে। আর এ মিশনেই জনস্বাস্থ্যে আনল ছকভাঙা ফর্মুলা, ম্যালেরিয়াকে নির্মুল করল চীন। দম্ভ করে ঘোষণা করে দিল- ম্যালেরিয়া শনাক্ত করতে হবে একদিনে, ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা জানাতে হবে ৩ দিনে, ছড়ানোর সম্ভাবনা আটকাতে হবে ৭ দিনে। আর তেমনটাই করে দেখাল অন্যতম বিশ্বশক্তির দেশ চীন।
কেন আমাদের কাছে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা অবশ্যই বিশ্লেষণের দাবি রাখে। মশাবাহিত রোগ আমাদের দেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে বহু বছর ধরেই। ম্যালেরিয়ার হাত থেকে আজো আমরা পরিত্রাণ পাইনি। আজো আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে ম্যালেরিয়া। কয়েক বছর ধরে নতুন করে যোগ দিয়েছে আর এক মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু। করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু আমাদের সমাজজীবনকে আছড়ে-পিছড়ে মারছে। প্রতি বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এই ডেঙ্গু হানা দেয় আমাদের। আমাদের প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, মানুষ সবাই হাহাকার করে, চিৎকার করে, হুমকি প্রদর্শন করে। তারপর প্রাদুর্ভাব একটু কমে গেলেই আবার সব চুপ হয়ে যায়। কিন্তু ডেঙ্গু আবার ঘুরে আসে। না আছে প্রতিকারে কোনো গবেষণা, না আছে স্থায়ীভাবে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা। এমন অবস্থায় চীনের সেই ১-৩-৭ ফর্মুলার উদাহরণ প্রণিধানযোগ্য বৈকি!

সুধীর সাহা : কলাম লেখক।
[email protected]

 

জা. ই

সর্বশেষ

জনপ্রিয়